ঝরনার ওপরেই তৈরি হয়েছে ফলিং ওয়াটার বাড়ি। ছবি: ভূঁইয়া মুনিরদক্ষিণ পেনসিলভানিয়ার এক গভীর অরণ্যে আলোছায়া আর গাছপালায় ঘেরা পাথুরে এক পাহাড়ের মধ্যে বয়ে যাচ্ছে এক ঝরনা। এই ঝরনার ওপর ঝুলন্তভাবে (ক্যানটিলিভার ধারণা) তৈরি করা এক স্বপ্নের বাড়ি। এ বাড়ির নাম ‘ফলিং ওয়াটার’। যুক্তরাষ্ট্রে অবসরযাপনের উল্লেখযোগ্য এই বাড়ির নকশা করেছেন বিশ্বখ্যাত স্থপতি ফ্র্যাঙ্ক লয়েড রাইট। এডগার জে কফম্যানের জন্য স্থাপত্য নকশা করেছিলেন তিনি। ১৯৩৫ সালে পরিকল্পনা আর ১৯৩৬ থেকে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত চলে এ বাড়ির নির্মাণকাজ। অনেক বছর ধরে কফম্যান পরিবারের সদস্যরা বাড়িটি ব্যবহার করলেও এই শতাব্দীর এই সময়ে এসে আজ এটি হয়ে দাঁড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের স্থাপত্য নিদর্শনগুলোর একটি গৌরবময় উদাহরণ। পর্যটকদের জন্য এটি এখন দর্শনীয় এক স্থান।
![স্থাপত্য মিশে গেছে প্রকৃতিতে](https://lh3.googleusercontent.com/blogger_img_proxy/AEn0k_uflmrHJim-IIwAU6FZCD6BIUqjrTsGzwGqKvECgj8F-hUs2WYm4OWiBEJf4GqkKTTapatvw1MfYNl1cLDIchnHw9rhVhVDWiCHceyFZiQTZxyQ9KDNjeLK3puG8T40JP-3Vled-gxaKKOTzuhx3DEvlqehNCFYRzCvsIjCztxQ4ryG_sZlgunTj3OUOvhxX-fdOqUCeHF6jebsCur_VU2HMXGOeo-7LYY=s0-d)
কিছুদিন আগে গিয়েছিলাম ফলিং ওয়াটার দেখতে। রডোডেনড্রনের ভিড়ে বাড়িটির উদ্দেশে হাঁটা শুরুর কিছুক্ষণের মধ্যেই শুনতে পাই দূর পাহাড়ি ঝরনার কুল কুলু মোহনীয় আহ্বান। আশপাশের নানা বন্য পাখির কলরব, ঝরনার ডাক আর নাম না জানা নানা গাছের মধ্যে সর্পিল সরু আলোছায়ামাখা সে পথ পর্যটককে এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকে। চলতে চলতে একসময় হঠাৎ করেই প্রকৃতির চিরন্তন শান্ত নিবিড় ফ্রেমে বেশ উঁচু থেকে কোনাকুনিভাবে ধরা পড়ে ‘ফলিং ওয়াটার’ বাড়িটি। জানালা, দরজা, ছাদ, কার্নিশ দেওয়া সাধারণ কোনো বাড়ি নয়। কিছু রঙিন পাথরের ওপর ডানে-বাঁয়ে প্রসারিত হয়ে কংক্রিট নিয়ে পাহাড়ি ঝরনার ওপর গাছপালা সাথি করে তেলচিত্রের মতো বসে আছে বাড়িটি। যেন বনপাহাড়ি ঝরনাস্নাত রাজকন্যা। কোথাও প্রকৃতির এতটুকু নাড়াচাড়া হয়নি, যেন এমনটিই থাকার কথা ছিল।
স্থপতি ফ্র্যাঙ্ক লয়েড রাইট শুরুতেই সচেতন হয়ে পাথুরে পাহাড়ের ডানে-বাঁয়ে কিছু পাথর বের করে এনে তার ওপর সাজিয়ে দিয়েছেন কংক্রিটের প্রসারিত ঝুলন্ত বড় বড় কিছু স্ল্যাব। কংক্রিট, বেলে পাথর (স্যান্ডস্টোন), ইস্পাত, কাজ, পাথুরে দেয়াল, ফ্ল্যাগড স্টোন ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়েছে এ বাড়ি নির্মাণে। নানা আকার, আয়তন আর রঙের উপকরণগুলো এমনভাবে ব্যবহার করা হয়েছে যাতে চারপাশের রঙিন পাথর আর প্রকৃতির রঙের সাথে বাড়িটি মিশে যায়।
বাড়ির সামনের ঝরনার পানির ঠিক ওপরে ছোট্ট সেতু। বাড়িটিতে ঢোকামাত্রই প্রকৃতি ছুঁয়ে যাওয়া এক আশ্রয়স্থলের অনুভূতি পাওয়া যায়। নিচু সিলিংসহ টানা কাচের জানালা, লালচে ইস্পাতের টানা রেলিংসহ প্রসারিত স্ল্যাবগুলো খুব সহজেই বাইরের প্রকৃতিকে নিয়ে আসে বাড়ির ভেতরে। পাহাড়ের ধাপগুলোর যথার্থ ব্যবহারে বাড়িটিতে রয়েছে নানা প্রবেশপথ। সামনে-পেছনে উপরে-নিচে প্রতিটি দিকেই নানা ধাপ-উপধাপ পেরিয়ে চলে যাওয়া যায় প্রতিবেশী পাহাড়ের নিবিড় খোলা প্রাঙ্গণে।
গৎবাঁধা নিয়মে ‘ফলিং ওয়াটার’ বাড়িটিকে ঝরনার সামনে বাঁ পাশে না বসিয়ে এভাবে পাহাড় কুদে ঝরনার ঠিক মাঝেই বসিয়ে পাহাড়ি ঝরনার সঙ্গে শহুরে বসবাসের এক অদ্ভুত যোগসূত্র ঘটিয়েছেন স্থপতি—তা সহজেই বোঝা যায়। এ জন্যই বাড়িটি হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘অরগানিক আর্কিটেকচারের’ বিশিষ্ট উদাহরণ। প্রায় শত বছর পেরিয়ে গেছে, তৈরি হয়েছে নানা আধুনিক স্থাপত্য। তবুও ফ্র্যাঙ্ক লয়েড রাইটের এই স্থাপত্যকর্মটি কালজয়ী হয়ে বসে আছে সেই প্রথম সারিতেই।
No comments:
Post a Comment